ফলগাছ

ফলগাছ রোপণে করণীয়

গ্রীষ্মের শেষে প্রথম বৃষ্টি হলেই আমরা গাছ রোপণের কথা চিন্তা করি। ভাবি, বাড়ির আশপাশের ফাঁকা জায়গাটা এবার গাছে গাছে ভরিয়ে দেবো। বাদ যাবে না ঘরের বারান্দা কিংবা ছাদও। অনেকের চিন্তাটা মাথার ভেতরেই ঘুরপাক খেতে থাকলেও অনেকে বাস্তবায়ন করতে মাঠেও নেমে পড়ি। প্রিয় গাছের চারা বা কলম খুঁজতে ছুটে যাই সরকারি বা বেসরকারি নার্সারিতে। কাংখিত গাছের চারা বা কলম পেয়েও যাই। তাৎক্ষণিকভাবে রোপণের জন্য নির্দিষ্ট জায়গায় লাগিয়েও ফেলি। লাগিয়েই ভাবি, যাক কিছু দিনের মধ্যেই জায়গাটা সবুজে সবুজে ভরে যাবে। কিন্তু না, ভাবনার সাথে বাস্তবতাটা ঠিক মেলে না। ক’দিন পরেই দেখা যায় চারা বা কলম সঠিকভাবে বাড়ছে না। শুকিয়ে মরে যাচ্ছে। কী যে হলো চারাগুলোর। চারা বা কলমের এই সমস্যাটা কিন্তু কিছু বিষয়ের প্রতি লক্ষ্য রাখলেই দূর করা যায়। তাহলে চলুন কারণগুলো একে একে জেনে নেয়া যাক।

গ্রীষ্মের শেষে প্রথম বৃষ্টি হলেই গাছের চারা বা কলম রোপণ করা ঠিক নয়। একটু অপেক্ষা করতে হয় পরের দু’তিন বার বৃষ্টির জন্য। কারণ প্রথম বৃষ্টির পর মাটির ভেতরে সৃষ্টি হওয়া গ্যাস বের হওয়ার জন্য বা মাটিতে কিছুটা রস সঞ্চয়ের জন্য সময় দিতে হয়। তাই পর পর কয়েকবার বৃষ্টি হলে মাটির ভেতর ও বাইরের আবহাওয়া প্রায় সম পর্যায়ে চলে আসে। অর্থাৎ মাটির রস ও বাতাসের আর্দ্রতা বেড়ে যায়। এই অবস্খায় গাছের চারা বা কলম রোপণ করলে সেগুলো আর মরে না। প্রতিবìধকতা দূর হওয়ায় চারাগুলো তরতর করে বেড়ে উঠতে থাকে।

দেশের অনেক জায়গাতেই এখন মাঝে মধ্যে বৃষ্টি হচ্ছে। তাপমাত্রা বেশি থাকলেও বাতাসের আর্দ্রতা আগের তুলনায় বেশ বেড়ে গেছে। ফল বা কাঠজাতীয় যেকোনো গাছের চারা বা কলম রোপণের সময় এখনই। এ জন্য বেশ কিছু করণীয় কাজের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- চারা বা কলম নির্বাচন, রোপণের জায়গা ঠিক করা, চারা বা কলমের জাত অনুসারে সঠিকভাবে গর্ত তৈরি, গর্তে সঠিক নিয়মে সার ব্যবহার, গর্তে সঠিক নিয়মে চারা বা কলম রোপণ এবং রোপণ করা গাছের সুরক্ষা প্রদান।

রোপণ করার জন্য যে চারা বা কলম নির্বাচন করা হবে তার বয়স কখনোই এক বা দু’ বছরের বেশি হওয়া চলবে না। আমাদের অনেকেরই ধারণা, বড় আকারের চারা বা কলম রোপণ করলে সেটা খুব তাড়াতাড়ি বড় হবে এবং ফল দিতে শুরু করবে। সত্যি বলতে কি ধারণাটি একদম ভুল। ছোট আকারের নিখুঁত ও তেজি চারা বা কলম সহজেই পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে পারে এবং দ্রুত বেড়ে ওঠে। চারা বা কলম বাছাই করার সময় আরো যেসব বিষয়ের দিকে খেয়াল রাখা জরুরি। চারা বা কলমের নতুন পাতা থাকলে সেই চারা বা কলম রোপণের জন্য বাছাই করবেন না। চারা বা কলমে ফুল বা ফল থাকলে সেটাও রোপণের জন্য বাছাই করবেন না। রোপণের জন্য বাছাই করা চারা বা কলমটি সোজা হতে হবে, দুর্বল বা বাঁকা চারা বা কলম বাদ দিতে হবে। বেশি শাখা-প্রশাখাযুক্ত চারা বা কলম বাছাই করবেন না। বেশি শাখা-প্রশাখা থাকলে সেগুলো ছাঁটাই করে শুধু মূল কাণ্ডটি রেখে রোপণ করতে হবে। রোপণের আগে নিচের দিকের কিছু পাতার অর্ধেক ছাঁটাই করে দিতে হবে। এতে চারা বা কলম থেকে পানি বের হয়ে গাছ শুকিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকবে না। কলমের গাছের বেলায় জোড় ঠিকমতো আছে কি না, তা পরখ করে নিতে হবে। বিশেষ করে আদিজোড়ে কোনো ফাটা দাগ আছে কি না, তা দেখে নিতে হবে। যদি থাকে তাহলে সেই কলম বাদ দিতে হবে। কলমের জায়গার পলিথিন খোলা হয়েছে কি না রোপণের আগে সেটাও দেখে নিতে হবে। চারা বা কলমের পাতা কোনো ধরনের পোকামাকড়ে আক্রান্ত থাকলে তা ছাঁটাই করে ফেলতে হবে। প্রয়োজনে ছত্রাকনাশক দিয়ে চারা বা কলম ভালোভাবে স্প্রে করার পর রোপণ করতে হবে।

রোগাক্রান্ত কোনো চারা বা কলম রোপণের জন্য বাছাই করা ঠিক হবে না। বিশ্বস্ত উৎস বা প্রতিষ্ঠান থেকে সঠিক তথ্য নিয়ে উন্নত জাতের চারা বা কলম সংগ্রহ করে রোপণ করতে হবে। চারা বা কলমের শিকড় পলিব্যাগ বা মাটির পট ভেদ করে বের হয়েছে কি না সেটা দেখে নিতে হবে। যদি শিকড় বের হয় তাহলে সেটা ছাঁটাই করে দিতে হবে। পলিব্যাগ বা মাটির পটের মাটি ঠিক আছে কিনা সেটাও দেখে নিতে হবে। যদি চারা বা কলমের গোড়ার মাটি আলগা হয়ে সরে যায় কিংবা পট বা পলিথিন থেকে চারা বা কলম বের করার পর মাটির বল ভেঙে যায় তাহলে সেই চারা বা কলম বাদ দেয়া ভালো। চারা বা কলম কোথায় রোপণ করা হবে সেই জায়গাটি আগে থেকেই নির্ধারণ করতে হবে। রোদ পড়ে এবং ভবিষ্যতে বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে কোনো রকম বাধার সৃষ্টি না হয় এমন জায়গাই নির্বাচন করতে হবে। চারা বা কলম রোপণের আগেই বড় গাছের জন্য (আম, কাঁঠাল, লিচু, নারিকেল, বাতাবি লেবু, সফেদা) দৈর্ঘ্য-প্রস্খ ও গভীরতায় ১ বর্গ মিটার গর্ত খনন করে কমপক্ষে ৭-১০ দিন খোলা অবস্খায় ফেলে রাখতে হবে। এ সময় গর্ত থেকে তোলা মাটি ঝুরঝুরে করে তার সাথে জৈব সার মিশিয়ে রাখতে হবে।

মাঝারি গাছের জন্য (পেয়ারা, লেবু, জলপাই, কামরাঙ্গা, আমড়া) দৈর্ঘ্য-প্রস্খ ও গভীরতায় ৬০ বর্গ সেন্টিমিটার গর্ত খনন করতে হবে। ছোট গাছের জন্য (কলা, পেঁপে, ডালিম) দৈর্ঘ্য-প্রস্খ ও গভীরতায় ৪৫ বর্গ সেন্টিমিটার গর্ত খনন করতে হবে। রোপণের ঠিক ৩-৪ দিন আগে জৈব সার মিশ্রিত মাটির সাথে রাসায়নিক সার মিশাতে হবে এবং মাটি দিয়ে গর্ত এমনভাবে ভরাট করতে হবে যেন জমির সমতল থেকে ভরাটকৃত মাটির উচ্চতা ১৫-২০ সেন্টিমিটার উঁচু হয়। ভরাট করা মাটি চার দিকে ঢালু করে দিতে হবে যেন পানি সহজেই গড়িয়ে যেতে পারে। এ সময় প্রয়োজনমতো পানি গর্তের মাটিতে দিতে হবে, যাতে মাটিতে রসের অভাব না হয়। এরপর গর্তের ঠিক মাঝখানে নিড়ানি বা হাত দিয়ে পট বা পলিব্যাগের সমান করে বা একটু বড় করে গর্ত করতে হবে। গর্তের মাঝে চারা বা কলম স্খাপন করতে হবে এমনভাবে যেন চারা বা কলমের গোড়া আগের অবস্খাতেই থাকে। অর্থাৎ আগে যেটুকু মাটির বলের নিচে ছিল কিংবা যেটুকু মাটির বলের বাইরে ছিল ঠিক সেভাবেই যেন থাকে। এতে চারা বা কলমের গোড়ার বাকল ঠিক থাকে এবং গোড়াপচা রোগ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না। রোপণ করার পরপরই গাছে এবং গাছের গোড়ার চার দিকে কিছুটা পানি ছিটিয়ে দিতে হয়। রোপণ করা চারা বা কলমের সুরক্ষার জন্য ঘেরার ব্যবস্খা করতে হবে।
লেখক : খোন্দকার মেসবাহুল ইসলাম, কৃষিবিদ, উদ্যান বিশেষজ্ঞ, হর্টিকালচার সেন্টার, রংপুর
এগ্রোবাংলা ডটকম

মাটির গুণাগুণ জেনে ফলের গাছ লাগাবেন

বাংলাদেশে প্রাপ্ত বেশিরভাগ ফল গাছই দেশের সর্বত্র কম-বেশি জন্মে থাকে। এর কারণ দেশের এক স্থান থেকে অন্য স্থানের আবহাওয়ায় তারতম্য খুব বেশি নয়। দেশের এক এলাকা থেকে অন্য এলাকার মাটির গুণাবলীর কিছুটা পার্থক্য আছে, সেই সঙ্গে আবহাওয়ার কিছুটা তারতম্য থাকায় যে স্থানে কোনো একটি ফল অল্প পরিশ্রমে সার্থকতার সঙ্গে এবং অধিকতর লাভজনকভাবে উত্পাদন করা যায়, সেই স্থানেই মানুষ বাণিজ্যিকভাবে ওই ফল চাষ করতে শুরু করেছে। আবহাওয়ার বিভিন্ন উপাদান এবং মাটির গুণাবলী ফল গাছের ফল ধারণ, বৃদ্ধি এবং সংরক্ষণ- ইত্যাদি বিষয়গুলোকে কীভাবে প্রভাবিত করে সে সম্পর্কে নিম্নে সংক্ষেপে আলোচিত হলো-

ক. তাপমাত্রা : একেক ধরনের ফল গাছের বৃদ্ধি এবং ফল ধারণের জন্য একেক ধরনের তাপমাত্রার প্রয়োজন হয়। নির্ধারিত পরিধির চেয়ে তাপমাত্রা কম-বেশি হলে ফল চাষে বিঘ্ন সৃষ্টি হয়। একই ফলের বিভিন্ন জাতের মধ্যেও তাপমাত্রার প্রয়োজন ভিন্ন ভিন্ন ধরনের হতে পারে।

খ. বৃষ্টিপাত : সব ধরনের ফল গাছেরই বৃষ্টিপাতের চাহিদা সমান নয়। বৃষ্টিপাত কম কিংবা অধিক বৃষ্টি অনেক ফল গাছের ক্ষতি সাধন করে। গাছে ফুল ফোটার সময় অধিক বৃষ্টি হলে পরাগ রেণু ও গর্ভমুণ্ডের আঠালো রস ধুয়ে যায়। ফুলে কীট-পতঙ্গের বিচরণ কমে যায়, এর ফলে নিষেকক্রিয়া ব্যাহত হয়ে ফল উত্পাদন হ্রাস পায়।
বাংলাদেশে ফল উত্পাদনের ক্ষেত্রে আবহাওয়ার উপাদানগুলোর মধ্যে তাপমাত্রা ও বৃষ্টিপাত এ দুটিই অধিক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে তাপমাত্রা এবং বৃষ্টিপাতের ক্ষেত্রে ঋতুভেদে কিছুটা তারতম্য পরিলক্ষিত হয়।

গ. আলো : ফল গাছের বৃদ্ধি, ফল উত্পাদন এবং ফলের গুণগতমান অক্ষুণ্ন রাখতে আলোর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। বিভিন্ন ধরনের ফল গাছের জন্য আলোর চাহিদায় ভিন্নতা রয়েছে।

ঘ. বাতাসের আর্দ্রতা : ফলের আকার, আকৃতি, রং, গুণগতমান ইত্যাদি বাতাসের আর্দ্রতার উপর অনেকাংশে নির্ভর করে। অনেক ফল শুষ্ক আবহাওয়ায় ভালো জন্মে, আবার কিছু কিছু ফল উত্পাদনের জন্য আর্দ্র আবহাওয়া প্রয়োজন হয়।

ঙ. বাতাসের গতিবেগ : বাতাসের গতিবেগ ফল চাষের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বাতাসের গতিবেগ বৃদ্ধি পেলে গাছ এবং মাটির রস দ্রুত নিঃশেষ হয়, এজন্য ঘন ঘন পানি সেচের প্রয়োজন হয়। এর ফলে উত্পাদন খরচ বৃদ্ধি পায়। তাছাড়া ঝড়ো বাতাসে ফল গাছের এবং ফলের অধিক ক্ষতি সাধিত হয়।

চ. মাটির গুণাবলী : সাধারণত, উঁচু জমি ফল চাষের জন্য অধিক উপযোগী। দেশের সব স্থানের জমির গুণাবলীতেও বেশ পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। কোনো স্থানের মাটি লালচে, কোথাও কালচে, কোনো স্থানের মাটিতে বালির আধিক্য, আবার কোথাওবা কর্দমাক্ত। কোনো স্থানের মাটিতে লবণের ভাগ বেশি, কোথাও আবার অম্লমান অধিক। কোথাও কম নিষ্কাশিত, কোথাওবা সু-নিষ্কাশিত। পানির স্তর কোথাও কম, কোথাও বেশি। মাটির উর্বরতা এবং ফল উত্পাদনের জন্য প্রয়োজনীয় বিভিন্ন উপাদানের তারতম্য রয়েছে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মাটিতে।

ফল গাছের পারিপার্শ্বিক উপযোগিতা বিচার করে এবং বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মাটি ও আবহাওয়ার বৈশিষ্ট্য, পরিবেশ, অর্থনীতি, ফলশিল্প এবং সামাজিক বিষয়াদির উপর ভিত্তি করে প্রধান প্রধান ফলের চাষ বিশেষ বিশেষ এলাকায় কেন্দ্রীভূত হয়েছে। নিম্নে বাণিজ্যিক উত্পাদনকারী জেলাসমূহের একটি তালিকা দেয়া হলো-

১. কলা-মুন্সীগঞ্জ, নরসিংদী, বগুড়া, রংপুর, জয়পুরহাট, গাইবান্ধা, কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা, রাঙামাটি, বান্দরবান ও ময়মনসিংহ।

২. পেঁপে-রাজশাহী, পাবনা, নাটোর, যশোর, খুলনা, ময়মনসিংহ, গাজীপুর, নরসিংদী, মুন্সীগঞ্জ, চট্টগ্রাম, রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ি।

৩. আম-চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, নাটোর, দিনাজপুর, কুষ্টিয়া, যশোর, মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা, পাবনা, গাজীপুর, রাঙামাটি ও রংপুর।

৪. লিচু-পাবনা, দিনাজপুর, রাজশাহী, গাজীপুর, নরসিংদী, নারায়ণগঞ্জ, নাটোর, কুষ্টিয়া, যশোর, ময়মনসিংহ ও পঞ্চগড়।

৫. কাঁঠাল-চট্টগ্রাম, ঢাকা, টাঙ্গাইল, গাজীপুর, নরসিংদী, রাঙ্গামাটি, দিনাজপুর, নাটোর, পঞ্চগড়, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, নরসিংদী ও কুষ্টিয়া।

৬. আনারস-সিলেট, টাঙ্গাইল, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান, চট্টগ্রাম ও নরসিংদী।

৭. তরমুজ-চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, ঠাকুরগাঁও, নাটোর, কুষ্টিয়া, যশোর, কুমিল্লা, পটুয়াখালী ও রাজবাড়ী।

৮. আমড়া-বরিশাল, ঝালকাঠি, মাদারীপুর, পিরোজপুর ও যশোর।

৯. পেয়ারা-বরিশাল, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, যশোর, পাবনা, গাজীপুর, কুমিল্লা, রংপুর, নাটোর, রাঙামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি।

১০. নারিকেল-পটুয়াখালী, খুলনা, বাগেরহাট, ভোলা, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, ফরিদপুর, মাদারীপুর, রংপুর ও নাটোর।

১১. লেবু জাতীয় ফল-সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, পাবনা, নাটোর, রাঙামাটি, রংপুর, পঞ্চগড় ও খাগড়াছড়ি।

১২. কুল-পাবনা, রাজশাহী, রংপুর, গাজীপুর, কুমিল্লা, বরিশাল ও সিলেট।

ই-মেইল : [email protected]
লেখক : মো. আলী আশরাফ খান, প্রধান নিরীক্ষা কর্মকর্তা, বিসিক, ঢাকা।
এগ্রোবাংলা ডটকম

ফলের বাগান করার আগে ও পরে যা করবেন

ফলের বাগান করার ইচ্ছে অনেকেরই থাকে। ফলের বাগান করার আগে কিছু প্রস্তুতিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হলে ভবিষ্যতে লাভের মুখ দেখা সহজ হবে। শুধু তাই নয়, দেশে ফলের বাগান বাড়লে বিদেশ থেকে ফল আমদানিও কমবে। ফলের বাগান করে আপনিও বাড়তি আয়ের ব্যবস্থা করে নিতে পারবেন।

বাগানের সার্বিক সুরক্ষার খাতিরে ভূমি প্রস্তুতকরণের সঙ্গে সঙ্গে বাগান এলাকার চারদিকে স্থায়ীভাবে বেড়া, এমনকি পাকা দেয়াল নির্মাণের কাজটি সারতে পারেন। প্রতি চারার চারদিক ঘিরে বাঁশের বেড়া দিলে তাত্ক্ষণিক গরু-ছাগলসহ অন্যান্য পশু থেকে গাছ রক্ষা করা যেতে পারে। কিন্তু মিশ্র ফল-বাগান হচ্ছে একটি দীর্ঘকালীন প্রকল্প।

বিভিন্ন উপদ্রব থেকে বাগানকে রক্ষার জন্য চারদিকে বেড়া দিতে হয়। স্থায়ী বেড়া ইট-নির্মিত, অস্থায়ী বেড়া বাঁশের দরজা দিয়ে তৈরি এবং হেজ বা জীবন্ত বেড়া গাছ দিয়ে তৈরি করতে হবে। জীবন্ত বেড়া দীর্ঘস্থায়ী হয়। স্বল্প-ব্যয়ে এটি সম্পন্ন করা যাবে। এ জন্য বাইরের দিকে সীমানা-বরাবর কাঁটা তারের বেড়া দেয়া যেতে পারে। আবার সরাসরিও হেজের গাছ করা যেতে পারে। কাঁটা তার টানার জন্য কংক্রিট-নির্মিত খাম কিংবা জিওলাজাতীয় খুঁটি স্থাপন করা যায়। হেজের গাছ ঝোপালো, ছাঁটাইয়ের জন্য উপযুক্ত, চিরসবুজ, ছাগলের আকর্ষণমুক্ত, কমযত্নে জন্মানোর উপযোগী এবং পোকা-মাকড় ও রোগবালাই প্রতিরোধ্য হলে ভালো হয়। দুরন্ত, কাঁটা-মেহেদী, শ্যাওড়া, করঞ্জা ও কামিনী উঁচু হেজ এবং জাস্টিসিয়া, ল্যান্টানা, অ্যাকালিফা, রঙ্গন, পাতাবাহার ও কোচিয়া অনুচ্চ হেজ তৈরির উপযোগী।

হেজের জন্য তিন সারি করে বীজ বপন করতে কিংবা শাখাকলম লাগাতে হয়। গাছগুলো প্রায় ৩০ সেন্টিমিটার উচ্চতাসম্পন্ন হওয়ার পর প্রথমবার ভুতল থেকে ১৫ সেন্টিমিটারের উপরের ডগাগুলো কেটে দিতে হবে। কিছু দিন পরপর প্রয়োজনমত ছাঁটাই করে গোড়ার দিকেই গাছগুলোকে ঝোপালো ও দৃঢ় করে নিতে হবে। হেজ উত্পাদন ও সংরক্ষণের জন্য নিয়মিত সার প্রয়োগ করা এবং দরকার মতো পানি-সেচ প্রদান আবশ্যকীয়। সেচের পানির উত্স অগভীর নলকূপ, টিউবওয়েল, কূপ, পুকুর ইত্যাদি। পাম্প, রবার নল, ঝারি ইত্যাদি সেচ কাজে ব্যবহৃত হয়। নার্সারি বা উদ্যানে উত্তম পানি-নিকাশ ব্যবস্থা থাকতে হবে। জমি উঁচু হওয়া ও একদিকে ঢালু করে দেয়া এবং প্রয়োজনমত সঠিক স্থানগুলোয় বা রাস্তার পাশ দিয়ে নিকাশ-নালা খনন করে নেয়া ভালোভাবে পানি-নিকাশের পূর্ব শর্ত।

প্রতিটি চারাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য প্রাথমিকভাবে সকাল-বিকাল গাছের গোড়ায় অল্প-বিস্তর পানি-সেচন করলেই চলবে। কিন্তু মিশ্র ফল-বাগানের বিষয়টা সাময়িক নয়, সম্পূর্ণই দীর্ঘকালীন। যারা জোড়াতালি করে কোন ধরনের কতগুলো গাছকে দাঁড় করিয়ে দিলেই চলবে এবং গাছগুলো একটু বড় হলেই পানির ব্যবস্থা ও অন্যান্য যত্ন নিজেরাই করে নেবে বলে চিন্তা করবেন, তাদের জন্য ফল-বাগান করা যুক্তিযুক্ত নয়। বৃক্ষজাতীয় ফল-বাগান অবশ্যই দালান-কোঠার মতোই একটি দীর্ঘকালীন বিষয় বলতে গেলে ১০০ বছর মেয়াদি পরিকল্পনা। যদি দালান-কোঠা নির্মাণ কাজে পানির ব্যবস্থার কথা ভাবতে হয় এবং প্রয়োজন বুঝে ব্যবস্থা নিতে হয়, তবে ফল-বাগানের বেলায়ও এটি হবে প্রযোজ্য।

সেক্ষেত্রে চারা ঠিকমত বসে যাওয়ার আগেই শুষ্ক জলবায়ু এসে পড়ার কারণে শুষ্ক মৌসুমে পানি-সেচের ভালো ব্যবস্থা থাকা চাই। বর্ষার আগেভাগে চারা টিকে গেলে তথা সেট হয়ে গেলে, সেটি বাগানের মালিককে অনেকটাই চিন্তামুক্ত অবস্থায় রাখতে পারে।

চারা রোপণের সর্বাপেক্ষা উত্তম সময় গ্রীষ্মকালের প্রায় সবটা আর বর্ষাকালের প্রথম দিকটা। অর্থাত্ বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ ও আষাঢ় মাস। শ্রাবণ-ভাদ্র মাস তথা ভরাবর্ষা পরিহার করা যুক্তিযুক্ত। ভরা বর্ষায় চারা পচে যাওয়া ও মরে যাওয়ার সম্ভাবনা অধিক হয়। আশ্বিন মাসে চারা রোপণ করা চলে।

চারা রোপণের আগের কাজটি হচ্ছে গর্ত তৈরি করা। অধিকাংশ বৃক্ষ-শ্রেণীর ফলগাছের বেলায় দুই ফুট ব্যাস ও গভীরতা বিশিষ্ট গর্ত খনন করা যেতে পারে। বলতে পারেন আম, কাঁঠাল, লিচু, লেবু ইত্যাদি গাছগুলোর বড় আকারের কথা। ওই আকার হচ্ছে পরিণত-বয়স্ক গাছের। কিন্তু চারা অবস্থায় গাছগুলোর আকার যেমন প্রায় একরূপ হয়ে থাকে, তাদের রোপণও হতে পারে প্রায় একই আকারের গর্তে। প্রারম্ভিক সারের প্রকার ও পরিমাণও হতে পারে অনেকটা একইরূপ। গর্তের মাটির সঙ্গে ১০ কেজি গোবর সার, ২৫০ গ্রাম টিএসপি এবং ১০০ গ্রাম এমওপি সার মিশিয়ে দিতে হবে।

এক্ষেত্রে নিম্নরূপ পদ্ধতি ব্যবহার করা ভালো। গর্তের একার্ধ, তথা উপরের দিকের মাটি গর্তের একপাশে আর অপরার্ধ বা নিচের দিকের মাটি অপর পাশে রাখতে হবে। এ অবস্থায় ১০/১৫ দিন (নিদেনপক্ষে এক সপ্তাহকাল) খোলা অবস্থায় রেখে গর্তে ও তোলা মাটিতে রোদ-বাতাস লাগানো মন্দ নয়। তত্পর উপরের মাটির সঙ্গে সার মিশিয়ে সার-মিশ্রিত মাটি গর্তের নিচের অংশে ঢেলে দিয়ে, অবশিষ্ট তথা নিচের দিকের মাটি উপরাংশে দিয়ে গর্ত পূরণ করে দিতে হবে।

বৃষ্টি না হলে চারা রোপণের পূর্বদিন গর্তে কিছু পানি-সেচ দেয়া যেতে পারে। রোপণের জন্য বিকালই প্রকৃষ্ট সময়। চারার শেকড় যতখানি বিস্তৃত ও গভীর, সে পরিমাণ গর্তের মাটি উঠিয়ে নিয়ে গর্তে চারার নিম্নাংশ প্রবেশ করিয়ে দিতে হবে। তার পর মূলগুলোকে গর্তের মধ্যে বেশ ভালোভাবে ছড়িয়ে দিয়ে আস্তে আস্তে মাটি চাপা দিতে হয়। লক্ষ্য রাখতে হবে, যেন চারাটির গোড়া পূর্ববর্তী মাটিতে যে স্থান পর্যন্ত অভ্যন্তরে ছিল এখানেও তাতে ততখানি পর্যন্ত মাটি চাপা দেয়া পড়ে। রোপণের পরে গোড়ার মাটি একটু চাপিয়ে দেয়া উত্তম। চারা রোপণের অব্যবহিত পরে এবং প্রথম কিছু দিনের জন্য প্রতিদিন ঝারি দ্বারা চারার গোড়ায় পানি সেচন করা উচিত। তা ছাড়া চারার উপরে ছায়াদানের ব্যবস্থা করা এবং গোড়ার মাটি শুষ্ক ঘাস, খড় ইত্যাদি দ্বারা ঢেকে দেয়া মন্দ নয়। রোপণের ছয় মাস পর কিছু ইউরিয়া সার ‘টপড্রেসিং’ রূপে ব্যবহার করা যেতে পারে।
লেখক: ড. কামাল উদ্দীন আহমদ

এগ্রোবাংলা ডটকম
সুলভে কৃষি পন্য ক্রয়ে আস্থা রাখুন বাংলাদেশের প্রথম কৃষি ভিত্তিক ইকমার্স ‘এগ্রোবাংলা শপ’ এ।