মুক্তা

মাছের আঁশ থেকে মুক্তা

মাছের আঁশের নির্যাস থেকে তৈরি হচ্ছে মুক্তা। মৎস্য গবেষণা ইনস্টিউট স্বাদু পানিতে চীনের কয়েকজন বিশেষজ্ঞের পরিচালনায় মাছের আঁশের নির্যাস থেকে মুক্তা চাষ কর্মকাণ্ড বাস্তবায়িত করার চেষ্টা করেন। তবে এখনও টেকসই প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও সমপ্রসারণ সম্ভব হয়নি আমাদের দেশে। প্রযুক্তিগত আধুনিক মুক্তা চাষ ব্যবস্থাপনা কলাকৌশলের মাধ্যমে এই শিল্পের উন্নয়ন সম্ভব। বাংলাদেশের এক পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, কৃত্রিম মুক্তা উৎপাদন সম্ভব হলে বছরে ১৫০০ কোটি টাকা বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব। এছাড়া ২০ থেকে ৩০ লক্ষ লোকের এ শিল্পে কর্মসংস্থানের সুযোগ হতে পারে।

প্রাকৃতিক মুক্তা ও কৃত্রিম মুক্তা:
ঝিনুকের মধ্যে প্রাকৃতিকভাবে মুক্ত জন্মালে তাকে প্রাকৃতিক মুক্তা বলে। আর কৃত্রিমভাবে যে মুক্তা উৎপাদন করা হয় তাকে বলা হয় কৃত্রিম মুক্তা। প্রাকৃতিক ও কৃত্রিম উপায়ে তৈরি মুক্তার মধ্যে কোন তফাৎ নেই।

কৃত্রিম মুক্তা তৈরির নির্যাস:
মাছের আঁশের উপরের ত্বক থেকে বেরোনো উজ্জ্বল নির্যাসকে রাসায়নিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কৃত্রিম মুক্তা তৈরির প্রধান উপাদান হিসেবে ধরা হয়। এই নির্যাসের দীপ্তিকারক উজ্জ্বলতা মাছের উপরের ত্বকের প্রধান জৈব উপাদন গুয়ানিন (২-এ্যামিনো, ৬ অকিইপউরিন রয়েছে) সমৃদ্ধ। মাছের আঁশের উপরের ত্বকে গুয়ানিন থাকার কারণে এটি কলাজেন এবং ক্যালসিয়াম ফসফেটের বিক্রিয়ার ফলে সাদা রূপালি বর্ণ ধারণ করে। এই দীপ্তিকারক রূপালি উজ্জ্বল নির্যাস সাধারণত সামুদ্রিক হোয়াইটিং, সারডিন, হেরিং, রিবন ফিশ এবং মিঠা পানির কিছু কার্প জাতীয় মাছের আঁশে থাকে। সাধারণত এই উজ্জ্বল নির্যাস সারডিন এবং রিবন মাছে বেশি পাওয়া যায়।

শিল্পপ্রধান দেশে এই নির্যাস মুক্তা তৈরিতে ব্যাপক হারে ব্যবহার হয়ে থাকে। উন্নত পরিশোধন পদ্ধতিতে মাছের আঁশ থেকে নির্যাস বের করার পর এতে একরিলিক রাসায়নিক উপাদান মিশ্রিত করে কৃত্রিম মুক্তা তৈরির জন্য ছোট ছোট গ্লাসের গুটিকার প্রয়োজন হয়। নিম্নমানের কৃত্রিম মুক্তা প্লাস্টিক গুটিকা দিয়ে তৈরি করা। গুয়ানিন হল চতুষ্কাণ আকৃত্রির প্লেইটলেটস, স্ফটিক সমৃদ্ধ এবং স-র থেকে স-রে আলো সঞ্চারিত করে উজ্জ্বল কৃত্রিম মুক্তা তৈরি করা হয়। উচ্চমানসম্পন্ন গুয়ানিন তৈরির জন্য নির্যাস স্বচ্ছ পদার্থে ইথাইল এলকোহল প্রয়োগ করা হয়। এরপর পরিশোধিত গুয়ানিনে এসিটোন অথবা এমাইল এসিটেইট, অথবা সেলুলয়েড কিংবা নাইট্রোসেলুলোজ বা এলবুমিনের সাথে মিশ্রণ করে উন্নতমানের কৃত্রিম মুক্তা তৈরি করা হয়। যদিও এলবুমিন জাতীয় প্রোটিন মুক্তার উজ্জ্বলতা তৈরিতে অপরিহার্য তা সত্ত্বেও রাসায়নিক উপাদান মুক্তা তৈরির নির্যাস উৎপাদনে প্রধান ভূমিকা রাখে। মুক্তা তৈরির প্রধান রাসায়নিক পার্ল নির্যাস গুয়ানিন পানি, এলকোহল, ইথার, ক্লোরোফরম, ইথাইল এসিটেইট, এসিটিক এসিড এবং বেশির ভাগ জৈব এসিডে দ্রবীভূত হয় না। তবে, মিনারেল এসিড এবং এলকালিতেও এটি দ্রবীভূত হয়।

১৬৫৬ সালে ফ্রান্সের জপমালা (ধর্মীয় জপে ব্যবহৃত) প্রস্তুতকারক এক ব্যক্তি ফ্রনকয়েস জাকুইন প্রথমবারের মত মুক্তা তৈরির নির্যাস মাছের আঁশ থেকে উদ্ভাবন করেন। আজ বিশ্বে বিশেষ পরিশোধন পদ্ধতিতে কৃত্রিম মুক্তা উৎপাদিত হচ্ছে। ফ্রান্সে প্রথম আবিষ্কার হয় বলে ফ্রান্সের ভাষায় একে ‘ Ôesence d’orient’ বলা হয়ে থাকে।

পেসিফিক বৃটিশ কলোম্বিয়া হেরিং ফিসারী কতৃর্ক আহরিত হেরিং মাছের স্কেইল থেকে মুক্তা উৎপাদনের নির্যাস ব্যাপকভাবে উৎপাদন হয়ে থাকে। ১০০ টন হেরিং মাছের ১ টন স্কেইল হতে এক পাউন্ড মুক্তা তৈরির নির্যাস উৎপন্ন হয়।

নির্যাস সংগ্রহ পদ্ধতি:
সামুদ্রিক রিবন ফিশ কিংবা বেল্ট ফিশের আঁশ ধারলো ছুরি দিয়ে ভালভাবে চেঁচে এই রূপালি উজ্জ্বল নির্যাস সংগ্রহ করতে হয়। এই উজ্জ্বল রূপালি নির্যাস পানিতে বারবার নাড়াচাড়া কিংবা ঝাঁকিয়ে উজ্জ্বল গুয়ানিন স্ফটিক সমৃদ্ধ নির্যাস সংগ্রহ করতে হয়। এরপর তলানীতে পড়ে থাকা গাড় তরল পদার্থে অল্প পরিমাণ এসিটিক এসিড এবং ০.২৫ পেপসিন মিশিয়ে ৪৮ ঘন্টা ঘরের তাপমাত্রায় রেখে দিতে হয়। এতে রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে আত্মস্থ করে নেয়া হয় এবং নির্যাসে যে আমিষ কলা রয়েছে তা বের হয়ে আসে। এসিডিফিকেশনের জন্য এসিটিক এসিডও ব্যবহৃত হয়। আবার মেটালিক এসিড প্রয়োগ করলে গুয়ানিন আত্মস্থ করে ফেলে। এরপর ডি- প্রোপিনাইজড গুয়ানিন সমৃদ্ধ স্ফটিক পদার্থ বের করা হয় এবং ইথার দ্রবণ কিংবা গগসোলিন দ্রবণে মিশ্রিত করা হয়। পরে গুয়ানিন সমৃদ্ধ স্ফটিক পদার্থ ভালভাবে জৈব শক্তিসম্পন্ন দ্রাবক স্তর সৃষ্টি হতে পারে। পানিতে মিশ্রিত ময়লা ও কোন বহিরাগত বস্তু পানির স্তরের নিচে ভাসতে থাকে। অল্প সংখ্যক চর্বিজাতীয় পদার্থ ইথার স্তরে অবস্থান নেয়। তখন ইথার স্তর সতর্কতার সাথে পৃথক করা হয়। গুয়ানিন সমৃদ্ধ স্ফটিক পদার্থ শুষ্ক ইথার দ্বারা সাথে সাথে ২ থেকে ৩ বার ধুতে হয় যাতে চর্বি রেরোতে পারে এবং এর পরবর্তী পর্যায়ে ইথার এবং ইথাইল এসিটেডে সংরক্ষণ করা হয়। রিবন ফিশের দেহের ওজন কমপক্ষে ০.৩% স্কেইল হতে মুক্তার নির্যাস পাওয়া যায়। উৎকৃষ্ট মুক্তার নির্যাস লম্বায় ৩০ মাইক্রোন এবং চওড়ায় ৩ মাইক্রোন ও আপেক্ষিক গুরুত্ব ১.৬ হয়ে থাকে। ফাঁকা গ্লাসের গুটিকায় মুক্তা নির্যাস যান্ত্রিক পদ্ধতিতে আবদ্ধ করে কৃত্রিম মুক্তা তৈরি করার পর গলিত মোম দ্বারা আবৃত করে রাখা হয় কিন্তু এ ধরনের ফাঁকা গ্লাসের গুটিকা দ্বারা সৃষ্ট মুক্তা সহজেই ভেঙ্গে যেতে পারে। উন্নতমানের মুক্তা তৈরির জন্য অপেল গ্লাস বা এলবাসটার ব্যবহার করা হয়।

রিবন ফিশ ছাড়াও অন্যান্য আঁশযুক্ত রূপালি মাছের আঁশ হতেও মুক্তার নির্যাস প্রস্তুত করা হয়। কিন্তু হেরিং ও রিবন ফিশের স্কেইল হতে যতটুকু নির্যাস পাওয়া যায় তা অন্যান্য মাছ হতে পাওয়া যায় না। রিবন ফিশ আমাদের বঙ্গোপসাগর এলাকায় প্রচুর পাওয়া যায়। যার কারণে অদূর ভবিষ্যতে আমাদের কৃত্রিম মুক্তা চাষের উজ্জ্বল সম্ভবনা রয়েছে।
এগ্রোবাংলা
সুলভে কৃষি পন্য ক্রয়ে আস্থা রাখুন বাংলাদেশের প্রথম কৃষি ভিত্তিক ইকমার্স ‘এগ্রোবাংলা শপ’ এ।