পেয়ারায় পোকা

পেয়ারায় পোকা ও প্রতিকার

প্রায়ই বাজারে পেয়ারা কিনতে গিয়ে মাঝে মধ্যে ঠকতে হচ্ছে। পাকা পাকা সুন্দর পেয়ারা অথচ কামড় দিলেই তার ভেতরে পোকা। ছুরি দিয়ে দোফালা করলে দেখা যায় ভেতরের শাঁস পোকায় খেয়ে নষ্ট করে ফেলেছে। সে পেয়ারা কি আর খাওয়া চলে? ক্রেতা-বিক্রেতা কারোরই পেয়ারা দেখে সহজে বোঝার উপায় নেই যে পেয়ারাটা আসলে পোকায় আক্রান্ত কি না। বাজার থেকে পেয়ারা কিনতে গিয়ে এখন তাই খুব সন্দেহ হচ্ছে মনে। কাল পেয়ারা কিনতে গিয়ে বিক্রেতাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘পেয়ারায় পোকা নেই তো?’ জবাবে বললেন, ‘পেয়ারার গায়ে টোকা দ্যান না। দ্যাহেন ক্যামুন টক্ টক্ আওয়াজ হয়। পোকায় ধরলে তো ঢ্যাপ ঢ্যাপ আওয়াজ হইত। সন্দেহ হইলে পরতেকটা পিয়ারা কাইট্যা দেখাইয়া দিমু। নিশ্চিন্তে নিবার পারেন।’ বিক্রেতার মুখের দিকে তাকালাম। এই সহজ উপায়টা সে জানলো কেমন করে? এত নিশ্চিতই বা হচ্ছে কী করে? জবাব পেলাম, ‘কারবার করবার গ্যালে কত কিছু জানতে হয়।’ তার কথা মেনে আমিও ফলের গায়ে টোকা দিয়ে বাজিয়ে দেখার চেষ্টা করলাম। নাহ্, টক্ টক্ আওয়াজই হচ্ছে। এখন বাকি পরীক্ষাটা হবে বাসায় গিয়ে খাওয়ার সময়। বাসায় এসে সন্দেহ ভরা মন নিয়েই কাটলাম। না, বিক্রেতার কথাই ঠিক। তবে চাষিদের ফোন ঠেকাব কী করে? তারা মাঝে মধ্যেই জানতে চাচ্ছেন, পেয়ারা এবার ঠেসে ধরেছে। কিন্তু সব পেয়ারা পোকায় নষ্ট করে দিচ্ছে। পেয়ারার গায়ে কোনো ছিদ্র নেই, খাওয়া নেই। অথচ তাজ্জব ব্যাপার, ভেতরে পোকা। আক্রান্ত পেয়ারার শাঁস বাদামি হয়ে নষ্ট হচ্ছে।

অন্যান্য ফসলের মতো পেয়ারাও প্রায় নানা রকমের পোকা দ্বারা আক্রান্ত ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ দেশে অন্তত পাঁচ রকমের পোকা পেয়ারা ফল ও গাছের ক্ষতি করে বলে জানা গেছে। এগুলো হলো সাদা মাছি বা হোয়াইট ফ্লাই, ফল ছিদ্রকারী পোকা বা ফলের মাছি, ছাতরা পোকা, জাব পোকা ও কাণ্ডের মাজরা পোকা। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করে ফলের মাছি ও ফল ছিদ্রকারী পোকা। ফল ছিদ্রকারী পোকা আক্রমণ করে কাঁচা অবস্খায় আর পাকার সময় আক্রমণ করে ফলের মাছি। ফল ছিদ্রকারী পোকার আক্রমণ হলে ফলের গায়ে কোথাও না কোথাও ছিদ্র হয়, ফল বিকৃত হয়ে যায়, ছিদ্রের মুখ দিয়ে পোকার মল পড়তে থাকে। কিন্তু ফলের মাছি পোকা আক্রমণ করলে গায়ে কোনো ছিদ্র হয় না, ফলও বিকৃত হয় না, রঙও ঠিক থাকে। শুধু ভেতরটা নষ্ট হয়ে যায়। অবশ্য খুব খেয়াল করলে মাঝে মধ্যে ফলের গায়ে তিলের মতো ক্ষুদ্র কোনো ক্ষত বা দাগ চোখে পড়ে। এর অর্থ ওখানে পেয়ারার খোসায় সূক্ষ্ম ছিদ্র করে সেখানে ফলের মাছি পোকা ডিম পেড়েছে। পেয়ারা যখন পাকতে শুরু করে তখন তার গন্ধে ফলের মাছি পোকা আকৃষ্ট হয়। বর্ষাকালে সাধারণত এদের আক্রমণ শুরু হয়। পাকা বা আধাপাকা ফলের গায়ে স্ত্রী মাছি পোকা বসে এবং পেয়ারার খোসার ঠিক নিচে ডিম গেঁথে দেয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই ছিদ্রমুখ শুকিয়ে বìধ হয়ে যায়। এ জন্য পরে আর ডিম পাড়া বা পোকা আক্রমণের কোনো লক্ষণই সহজে চোখে পড়ে না। কিন্তু ডিম ফুটে বাচ্চা বের হয়। ছোট্ট সাদা রঙের পাবিহীন লম্বা সুতোর মতো সে বাচ্চা ডিম থেকে বেরিয়েই পেয়ারার শাঁস খেতে শুরু করে। খেতে খেতে শক্ত শাঁসের খোল পেরিয়ে ভেতরে বীজযুক্ত নরম শাঁসের বলে ঢুকে পড়ে ও শাঁস খেতে খেতে বড় হতে থাকে। খায় আর মলত্যাগ করে। ফলে ভেতরে সুড়ঙ্গের সৃষ্টি হয় এবং শাঁস আংশিক বা পুরোটাই নষ্ট হয়ে যায়। সেসব পেয়ারা আর খাওয়ার যোগ্য থাকে না। অধিক আক্রান্ত পেয়ারা গাছ থেকে মাটিতে ঝরে পড়ে।

সমন্বিত ব্যবস্খাপনা পেয়ারা বাগান নিয়মিত পরিদর্শনে যেতে হবে। বিশেষ করে পেয়ারা ডাসা হওয়া শুরু করলে রোজই একবার গিয়ে গাছের তলায় দেখতে হবে। কোনো পেয়ারা সেখানে পড়ে থাকলে ছুরি দিয়ে দোফালা করে পোকার আক্রমণ হয়েছে কি না তা পরীক্ষা করতে হবে। যদি ঝরে পড়া পেয়ারা না পাওয়া যায় তাহলে গাছে পেকে ওঠা বা রঙ ধরা পেয়ারা দু-একটা ছিঁড়ে কেটে তার ভেতরটা পরীক্ষা করে দেখতে হবে। পোকার আক্রমণ দেখা গেলে দেরি না করে বাকি কাঁচা ফলগুলোকে ফলের মাছি পোকার আক্রমণের হাত থেকে রক্ষা করার ব্যবস্খা নিতে হবে। এ অবস্খায় ম্যালথিয়ন ৫৭-ইসি বা ফেনিট্রথিয়ন প্রতি ১০ লিটার পানিতে ১০ মিলিলিটার পরিমাণ মিশিয়ে গাছে স্প্রে করতে হবে। গাছের নিচে ঝরে পড়া কোনো ফল রাখা চলবে না।

তবে প্রথম থেকেই পেয়ারা বাগানে ধারাবাহিকভাবে কিছু কাজ করলে বাগানে আর এ পোকার আক্রমণ হয় না। যেমন- বর্ষাকালে পাকে এমন জাতের পেয়ারা না লাগিয়ে আগাম জাতের পেয়ারা লাগানো ভালো। অথবা গ্রীষ্ম-বর্ষায় ফল না নিয়ে শীতকালে ফল নেয়া যেতে পারে। এ জন্য ফুল ও ফল ছাঁটাই করে এ মৌসুমে গাছে কোনো ফল ধরতে না দিলে সেসব গাছে শীতে ফল ধরবে। শীতকালে এ পোকার আক্রমণ তেমন হয় না।

বর্ষাকাল শেষে ও বর্ষাকালের আগে পেয়ারা বাগানের জমি চাষ দিতে হবে। এ সময় সারও দেয়া যেতে পারে। এতে বাগানের মাটিতে লুকিয়ে থাকা এ পোকার পুত্তলি মারা পড়বে। পুত্তলি মারতে পারলে সেখানে মাছি পোকার সংখ্যা অনেক কমে যাবে।

পেয়ারাগাছে সেক্স ফেরোমন ফাঁদ ঝুলিয়েও এ পোকা নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে। সাদা বা হলুদ রঙের বয়াম বা থালা দিয়ে এ ফাঁদ বানানো যেতে পারে। পাত্রের নিচে থাকবে সাবান-পানি আর ওপরে একটা তারে সামান্য তুলা গুটি করে ঝুলিয়ে দিতে হবে। তুলার গুটিতে সেক্স ফেরোমন মিথাইল ইউজিনল ভিজিয়ে দিতে হবে। একটা তুলার গুটি ভেজানোর জন্য ৪ মিলিলিটার ফেরোমনই যথেষ্ট। এক একর পেয়ারা বাগানে এরূপ ফাঁদ ১ থেকে ২টি পাততে পারলেই যথেষ্ট। এসব ফাঁদে পেয়ারা মাছি পোকার পুরুষ পোকারা আকৃষ্ট হয়ে আটকা পড়ে মরে। ফলে বাগানে এ পোকার আক্রমণ অনেক কমে যায়। ফাঁদের সাদা বা হলুদ রঙ মাছি পোকাদের খুব আকৃষ্ট করে। তাই এ রঙের ফেরোমন ফাঁদ ব্যবহার করে আটকা পড়ার হার বাড়ে। মাটি থেকে ৫ ফুট বা প্রায় দেড় মিটার উঁচুতে পেয়ারা গাছের ডালে এ ফাঁদ ঝুলিয়ে দেয়া যায়। এ দেশের বাজারে এখন সেক্স ফেরোমন ফাঁদ পাওয়া যাচ্ছে।

সেক্স ফেরোমন ফাঁদ পাততে না পারলে একটা মাটির সানকিতে পাকা পেয়ারার ১০০ গ্রাম পরিমাণ শাঁস পিষে কাই করে তার ভেতরে ১২ ফোঁটা ডিপটেরক্স বা গìধ কম এমন যেকোনো কীটনাশক মিশিয়ে বিষ ফাঁদ তৈরি করে ব্যবহার করা যায়। সে ফাঁদে পুরুষ ও স্ত্রী উভয় মাছিই আটকা পড়ে। এ ফাঁদও ফেরোমন ফাঁদের মতো গাছে ঝুলিয়ে দেয়া যেতে পারে বা মাটিতে বাঁশের খুঁটি পুঁতে তাতে বেঁধে দেয়া যেতে পারে।

পেয়ারা গাছে যাতে এ পোকার আক্রমণ না হয় সে জন্য ফুল আসার মুহূর্ত থেকে তিনবার স্প্রে করে এ পোকার আক্রমণ প্রতিহত করা যেতে পারে। ফুল আসার মাস দেড়েক পর থেকে স্প্রে করা শুরু করতে হবে। প্রতি এক মাস পরপর মোট তিনবার গাছ ও ফলে কীটনাশক স্প্রে করতে হবে। ম্যালথিয়ন ৫৭-ইসি বা ফেনিট্রথিয়ন প্রতি ১০ লিটার পানিতে ১০ মিলিলিটার পরিমাণ মিশিয়ে গাছে স্প্রে করতে হবে। তবে কীটনাশক দেয়ার পর সপ্তাহ খানেকের মধ্যে কোনো পেয়ারা তোলা যাবে না।
এগ্রোবাংলা ডটকম
সুলভে কৃষি পন্য ক্রয়ে আস্থা রাখুন বাংলাদেশের প্রথম কৃষি ভিত্তিক ইকমার্স ‘এগ্রোবাংলা শপ’ এ।