মিল্ক ফিভার রোগ

গবাদিপশুর মিল্ক ফিভার রোগ

অধিক দুধ উৎপাদন এবং একই সাথে একের অধিক বাচ্চা প্রসবকারী গাভীর গর্ভাবস্থার শেষ তিন মাস, প্রসবকালীন সময় এবং প্রসব পরর্বতী ১-৪ দিনের মধ্যে ক্যালসিয়ামের অভাবে শারীরিক স্বাভাবিক তাপবৃদ্ধি ব্যাতিরেকে পেশির অবসাদগ্রস্থতার লক্ষণ প্রকাশ হওয়াকে দুগ্ধ জ্বর বলে।

রোগের কারণ
প্রধানত রক্তে আয়নাইজড ক্যালসিয়ামের পরিমাণ কমে যাওয়ার ফলে দুগ্ধ জ্বর হয়। দুধ দেয় (milking cow) এবং দুধ দেয় না কিন্তু গর্ভবতী এরূপ গাভীর (dry pregnant cow) ক্যালসিয়ামের পরিমাণে তারতম্য হয়ে থাকে। শুষ্ক পিরিয়ডে (dry period) প্রতিদিন ক্যালসিয়ামের চাহিদা থাকে ৪২ গ্রাম। পক্ষান্তরে দুগ্ধবতী গাভীতে প্রতিদিন এর পরিমাণ থাকা চায় ৮২ গ্রাম। শুধু তাই নয় dry pregnant cow G ক্যালসিয়াম শোষণের হার ৩৩% হলেও দুগ্ধ জ্বর প্রতিরোধের জন্য হদুগ্ধবতী গাভীতে এটি ৫২% থাকতে হবে।

প্রধানত তিন কারণে গাভীর হেদহে ক্যালসিয়ামের পরিমাণ হ্রাস পেয়ে দুগ্ধজ্বর হতে পারে।
১) গাভীর পাকান্ত্র থেকে শোষিত ও অস্থি থেকে রক্তে আগত ক্যালসিয়ামের পরিমাণ ভ্রূণ ও শালদুধের (colostrum) চাহিদার চেয়ে অধিক হলে এ রোগ দেখা দেয়।
২) গর্ভাবস্থা ও কলস্ট্রাম পিরিয়ডে পাকান্ত্রে সুষ্ঠুভাবে ক্যালসিয়াম শোষিত না হলে এ রোগ দেখা দেয়। গাভীর গর্ভকালীন সময়ে গর্ভস্থ বাচ্চার শারীরিক গঠন ও বৃদ্ধির প্রয়োজনে বিশেষ করে হাড়ের গঠন প্রক্রিয়ায় ক্যালসিয়ামের গুরত্ব অধিক। এ জন্য প্রতিদিন প্রায় ৫ গ্রাম করে ক্যালসিয়াম দরকার হয় এবং গর্ভস্থ বাচ্চা তার মার কাছ থেকে এ পরিমাণ ক্যালসিয়াম গ্রহণ করে।
নিম্নোক্ত কারণে পাকান্ত্রে ক্যালসিয়াম শোষণে ব্যাঘাত ঘটে থাকে-
ক) খাদ্যে ক্যালসিয়ামের অভাব
খ) ক্ষুদ্রান্তে অদ্রবণীয় ক্যালসিয়াম অক্সালেট লবণ সৃষ্টি
গ) অন্ত্রপ্রহদাহ (Enteritis)
ঘ) ক্যালসিয়াম ও ফসফরাসের অনুপাতের তারতম্য (স্বাভাবিক হার ২.৩:১)
ঙ) ভিটামিন ডি এর অভাব ইত্যাদি।
৩) অস্থির সঞ্চিত ক্যালসিয়াম দ্রুত ও পযার্প্ত হারে নিষ্ক্রান্ত না হওয়ার কারণে রক্তে ক্যালসিয়ামের স্বাভাবিক মাত্রা বজায় থাকে না। ফলে এ রোগ দেখা দেয়।

শরীরে ক্যালসিয়ামের ঘাটতি হলে প্যারাথাইরয়েড গ্রন্থি হতে নিঃসৃত প্যারাথরমোন শরীরের হাড় হতে ক্যালসিয়াম ও ফসফরাস নিঃসরণের জন্য উদ্দীপনা জোগায়। এ হরমোন ক্যালসিয়াম শোষণে ভূমিকা পালন করে। গর্ভকালের শেষ সময়ে খাদ্যে ম্যাগনেসিয়াসের ঘাটতি হলে এ রোগ দেখা দেয় এবং এ সময়ে গর্ভবতী গাভীর শরীরে ইস্ট্রোজেন হরমোনের পরিমাণ বাড়তে থাকে বিধায় এ হরমোন ক্যালসিয়াম নিঃসরণে বাধা দেয়। এ অবস্থা ছাড়াও অধিকহারে দানাদার খাদ্য গ্রহণ (grain engorgement), রুমেন নড়াচড়ায় আড়ষ্ঠতা (rumen stasis) বিশেষ করে ট্রমাটিক রেটিকুলোপেরিটোনাইটিস, উদরাময় জনিত না খাওয়া (starvation), জোর করে শারীরিক ব্যায়াম করানো (forced exercise) এবং অন্যান্য পরিবেশজনিত কারণ বিশেষ করে অতিরিক্ত ঠান্ডা ও বাতাসের আর্দ্রতার কারণে গাভীর শরীরে ক্যালসিয়ামের অভাব দেখা দিতে পারে।

রোগ লক্ষণ
গরুর রক্তের সিরামে স্বাভাবিক ক্যালসিয়াম এর মাত্রা হল ৯-১২ মিগ্রা/মিলি। এর মধ্যে অর্ধেক থাকে প্রোটিনের সাহেথ বন্ধনযুক্ত অবস্থায় (Protein bound) যা অকার্যকর। বাকী অর্ধেক থাকে আয়নিক অবস্থায়, যা ক্যালসিয়ামের সক্রিয় অংশ। সিরামের ক্যালসিয়াম লেভেল প্রতি ১০০ মিলিতে ৯ মিগ্রা এর নীচে আসলে সাবক্লিনিক্যাল লক্ষণ প্রকাশ পায়। গাভীর রক্তরসে ক্যালসিয়ামের পরিমাণের উপর র্নিভর করে রোগের লক্ষণ প্রকাশ পায়।

এপিডেমিওলজি
দুগ্ধ জ্বর হওয়ার পিছনে বেশ কিছু ফ্যাক্টর কাজ করে। এগুলো হলঃ

বয়স
গাভীর বয়স বৃদ্ধির সাথে এ রোগের প্রার্দুভাব বৃদ্ধি পায়। অধিক বয়স্ক গাভীতে (৪-৫ বাচ্চা প্রসবের পর) এ রোগ অধিক হয়। কারণ বৃদ্ধ বয়সে একদিকে অস্থি থেকে ক্যালসিয়াম মবিলাইজেশন হ্রাস পায়, অন্যদিকে পাকান্ত্রে ক্যালসিয়াম শোষণ হ্রাস পায়।

জাত
জার্সি জাতের গাভী (৩৩%) এ রোগ অধিক আক্রান্ত হয়। এছাড়া ব্রাউন সুইস s(Brown Swiss), আইশায়ার (Ayrshere), হলিস্টিন-ফ্রিজিয়ান (Holstein frizian) জাতের গাভীও এ রোগে আক্রান্ত হয়।

হরমোন
বাচ্চা প্রসবের কিছুদিন পুর্ব থেকেই এবং ইস্ট্রাস পিরিয়ডে ইস্ট্রোজেনের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। পরিণামে আন্ত্রিক গতিশীলতা হ্রাস পায় বলে অন্ত্রে ক্যালসিয়ামের শোষণ কমে গিয়ে হাইপোক্যালসেমিয়া বা দুগ্ধ জ্বর দেখা যায়। এছাড়া ইস্ট্রোজেন হরমোন অস্থি থেকে ক্যালসিয়াম মবিলাইজেশনেও বাধা দেয়।

অর্থর্নৈতিক গুরুত্ব
স্নায়বিক কার্যক্ষমতা বিঘ্নিত হওয়ার ফলে গাভীর স্বাভাবিক আচরণে অসামঞ্জস্যতা দেখা হেদয় এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে গাভী দাঁড়াতে পারে না। আক্রান্ত গাভীতে প্রসব জটিলতা, গর্ভফুল আটকে পড়া (কারণ এ সময়ে জরায়ুর মাংসপেশী শিথিল থাকায় জরায়ুর সংকোচন ক্ষমতা কমে যায় এবং গর্ভফুল বিচ্ছিন্ন ও পৃথক হওয়ার প্রক্রিয়াটি দীর্ঘায়িত হয়) ইত্যাদি জটিল সমস্যা পরিলক্ষিত হয়। এ ছাড়া জরায়ুর পেশীর শিথিলতা বা দুর্বল হওয়ার কারণে জরায়ু থলথলে (flabby) হয় এবং জরায়ুর র্নিগমনের (uterine prolapse) সম্ভবনা বেড়ে যায়। যথাসময়ে সঠিক চিকিৎসার অভাবে গাভী মারা যায়। মিল্ক ফিভার এর কারণে গাভীর উর্বরতা ক্রমান্বয়ে হ্রাস পায়। আক্রান্ত গাভীতে ওলান প্রদাহের সম্ভবনা বেড়ে যায়। কারণ, এ সময়ে বাঁটের স্ফিংটার পেশী শিথিল থাকার ফলে বাঁটের ছিদ্র (teat canal) দিয়ে ব্যাকটেরিয়া প্রবেশের সম্ভাবনা বেড়ে যায়। যথাসময়ে সঠিক চিকিৎসার ব্যবস্থা না করলে গাভী মারা যায়।

চিকিৎসা
দুধ জ্বরের সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা হল ক্যালসিয়াম বোরোগ্লুকোনেট (৪৫০ থেকে ৫৪০ মিলির ২০% সলিউশন)। এ মাত্রার সলিউশনে ৯ গ্রাম ক্যালসিয়াম থাকে যা সরাসরি শিরায় বা চামড়ার নিচে দিতে হয়। বাজারে এ ধরনের বিভিন্ন ক্যালসিয়াম সলিউশন এর যে কোনটি প্রস্তুতকারক কোমপানীর নির্দেশমত প্রয়োগ করতে হবে। চিকিৎসার ফলে প্রতিক্রিয়া দ্রুত হ্রাস পায় এবং ইনজেকশন দেয়ার সাথে সাথেই শতকরা ৬০ ভাগ এবং ২ ঘন্টার মধ্যে ১৫ ভাগ গাভী আরোগ্য লাভ করে। অপযার্প্ত মাত্রায় ক্যালসিয়াম সলিউশন দিয়ে চিকিৎসা করলে গাভী সম্পূর্ণ রোগমুক্ত হয় না এবং পশু উঠে দাঁড়াতে সক্ষম হয় না। অপরদিকে ক্যালসিয়াম সলিউশন অতিরিক্ত মাত্রায় এবং দ্রুত শিরায় ইনজেকশন দিলে পশুর মৃতু্যর আশঙ্কা থাকে । উল্লেখ্য, এ রোগে প্রতি লিটার দুধ হতে ১.২ গ্রাম ক্যালসিয়াম বের হয়ে যায়। হিসাব করে দেখা গেছে ১৮ লিটার দুধ দিতে সক্ষম একটি গাভীর প্রতি দিন ২২ গ্রাম ক্যালসিয়াম ব্যয়িত হয়। কাজেই উপরোক্ত পরিমাণ ক্যালসিয়াম শুধুমাত্র কয়েক ঘন্টার ঘাটতি পূরণে সক্ষম নয়। এ কারণে পূর্বের অবস্থার প্রত্যার্বতন প্রতিরোধে (Follow-up therapy) সরাসরি মুখে ক্যালসিয়াম দেয়া যেতে পারে। এ ধরনের ক্যালসিয়াম সলিউশন প্রদান করলে সিরামের স্বাভাবিক ক্যালসিয়াম লেভেল বজায় থাকে এবং পশুর Homeostatic পদ্ধতি কার্যকর হওয়া পর্যন্ত চালিয়ে যেতে হবে। উন্নত দেশগুলোতে শিরায় ক্যালসিয়াম দেয়ার পর দীর্ঘ সময় ধরে সিরামে (serum) ক্যালসিয়াম মাত্রা বজায় রাখার জন্য মুখে আয়নিক ক্যালসিয়াম (Ionic oral calcium) জেল form এ দেয়া হয়। আক্রান্ত গাভী যদি শক্ত বা পিচ্ছিল মেঝেতে শায়িত থাকে তবে খড় দিয়ে বিছানার ব্যবস্থা করে দিতে হবে।

প্রতিরোধ
প্রধানত দুটো নীতি অনুসরণ করে গাভীর দুগ্ধ জ্বর প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ করা যায়। যথাঃ
১) খাদ্য সংশোধন (Correction of diet) এবং
২) প্রি -ডিসপোজিং ফ্যাক্টর সংশোধন (Correction of pre-disposing factors)

খাদ্য সংশোধন
গাভীর শুষ্ক অবস্থায় ক্যালসিয়াম সরবরাহ পরিহার করতে হবে কারণ উচ্চ মাত্রার ক্যালসিয়াম থাকলে হাড়ের ক্যালসিয়াম মবিলাইজেশন নিষ্ক্রিয় অবস্থায় থাকে। ফলে বাচ্চা প্রসব ও কলস্ট্রামের জন্য প্রচুর ক্যালসিয়াম এর প্রয়োজনে অস্থি থেকে দ্রুত মবিলাইজেশন হতে পারে না। পাকান্ত্রে হঠাৎ গোলযোগ হলে ক্যালসিয়াম শোষণ হয় না। অপরদিকে অস্থি থেকে ক্যালসিয়াম মবিলাইজেশন হয় না। এর ফলে এ রোগের সৃষ্টি হয়। এ ধরনের গাভীদের কমপক্ষে ৩-৪ মাসের মত ২ চা চামচ করে ডাই ক্যালসিয়াম ফসফেট (DCP) পাউডার দৈনিক একবার খাবারের সাথে মিশিয়ে খাওয়াতে হবে। ভিটামিন ডি পাকান্ত্রের ক্যালসিয়াম শোষণ এবং অস্থি থেকে রক্তে ক্যালসিয়াম প্রবাহিত করতে সাহায্য করে। তাই ভিটামিন ডি প্রয়োগের মাধ্যমে এ রোগ প্রতিরোধ করা যায়।

প্রি-ডিসপোজিং ফ্যাক্টর সংশোধন
বয়স, জাত ও হরমোন লেভেলকে বিবেচনায় রেখে যথাযথ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। এছাড়া বাচ্চা প্রসবকালীন সময়ে যাতে ধকল না হয় তার ব্যবস্থা করতে হবে। এ জন্য বাচ্চা প্রসবের ৪৮ ঘন্টা পূর্ব ও পরে গাভীকে পর্যবেক্ষণ করতে হবে।

লেখক: ডাঃ এ. এইচ. এম. সাইদুল হক
এক্সিকিউটিভ, ভেটেরিনারী সার্ভিসেস, স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস
তথ্যসূত্র: পোলট্রি, পশুসম্পদ ও মৎস্য বিষয়ক মাসিক পত্রিকা ‘খামার’
সুলভে কৃষি পন্য ক্রয়ে আস্থা রাখুন বাংলাদেশের প্রথম কৃষি ভিত্তিক ইকমার্স ‘এগ্রোবাংলা শপ’ এ।